আজ ২৮শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আগামীর অঙ্গীকার হোক সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার

Spread the love

বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ

২১ শে ফেব্রুয়ারি যুগে যুগে বাঙালি জাতির জন্য প্ররণার উৎস। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের পর পাকিস্তান সরকার ঊর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করলে পূর্ব বাংলার জনগণের মনে গভীর ক্ষোভের দানা বাঁধতে শুরু করে এবং মাতৃভাষা বাংলাকে সম-মর্যাদার দাবিতে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙলো।

এসময় পুলিশ মিছিলের উপর গুলি ছুড়লে সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকেই শহিদ হন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে রাজপথ। শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারারুদ্ধ। তীব্র ভাষা আন্দোলনের মুখে পড়ে বাংলা ভাষাকে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানী সরকার এবং ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিলে ২৩ তারিখ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এ বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে আইন সভায় তুলে ধরেছিলেন এবং ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বলিষ্ঠ ভূমিকায় ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাীধনতা লাভ করে বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পর মহান সংবিধানে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। ১৯৭৪ সালের জাতিসংঘে ভাষণটিও বঙ্গবন্ধু বাংলায় দিয়েছিলেন। যেটি বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে ও বাঙালি জাতিকে আত্মমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সকল অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারী নির্দেশ জারি করেন। স্বাধীনতার পর থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারী এই দিনটি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা এখন বিশ্বের বহু দেশে গভীর শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে প্রতি বছর উদ্যাপিত হয়। প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ প্রজন্মও বাংলা ভাষার প্রতি চরম উদাসীন। তারা ভালো করে না শিখছে বাংলা, না ইংরেজি বাংলার সঙ্গে ইংরেজি-হিন্দি ভাষা মিশিয়ে ফরমালিনের থেকে বেশি বিষাক্ত করে তুলছে বাংলা ভাষাকে। যেখানে পুরো বিশ্বে একমাত্র জাতি হিসেবে বাঙালিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে ও বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্টিত করেছে সেই বাঙালির মাতৃভাষা আজ বিলুপ্তি বা হুমকির মুখে। যত্রতত্র দেয়ালে, ফেস্টুন, ব্যানারে, আলাপচারিতার মধ্যে ভাষাকে ছোট করে ভাষার অপব্যবহার বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে বাংলা নামটি ছোট করে লিখে ইংরেজিতে নামটি বড় করে লিখা হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা বিধায় সেটিকে আয়ত্ত করতে হবে ভালো কথা কিন্তু সেক্ষেত্রে বাংলাকে করতে হবে মূখ্য ভাষা এবং ইংরেজিকে করতে হবে গৌণ ভাষা এই বিষয়টিকে তরুণ প্রজন্মের খেয়াল রাখতে হবে। স্বাধীনতা-পরবর্তীতে বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারীর একুশ দিনটি আসলে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের রুল জারি সহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু দিবস চলে গেলে সেই প্রক্রিয়াটি স্তবির হয়ে পড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরও সব জায়গায় এখনো বাংলা ভাষা ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি।

আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেমন তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দিতে হবে তেমনি বাংলা ভাষার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, স্থাপত্য জানতে হলে আমাদের বাংলা ভাষার দুয়ার খুলতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশ চন্দ্র সেন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মোশাররফ হোসেন, কামিনী রায়, রজনীকান্ত সেন, প্রমথ চৌধুরী, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সুকুমার রায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অসংখ্য গুণ্য সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষায় লিখনীর মাধ্যমে বিশ্ব সভায় সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। আমাদের ঔপনিবেশিক মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে বসবাসরত প্রতিটি নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও এদের মধ্যে বেশির ভাগের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেন শুধু আবেগতাড়িত না হয়ে অমর একুশের কথা না বলি। একুশ তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। বাংলা ভাষার জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের এই আত্মত্যাগ তখনই স্বার্থক হবে যখন আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে পুরোপুরিভাবে সব জায়গায় প্রচলন করতে পারবো। অমর একুশের এই দিনে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর