আজ ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বৈষম্যহীন,সাম্য —সম্প্রীতির বাংলাদেশ ও আগামীর প্রত্যাশা

Spread the love

বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ

স্বাধীনতার ৫৩ বছর নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে ’২৪ এর ছাত্র—জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে এক নতুন যাত্রার সূচনা হয়েছে। অতিতের ইতিহাস বলে, তরুণ সমাজ, ছাত্র জনতা মুক্তিকামী। তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে আগামীর বাংলাদেশ হবে সাম্য ও সম্প্রীতি বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথায় যদি ফিরে যায় তবে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ কোন কাল্পনিক গল্পকাব্য ছিল না। বরং, মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাস্তব জীবনে দেশপ্রেম ও অস্তিত্বের লড়াই, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য রক্ত বিসর্জন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটা স্বাধীন ভূখণ্ড, লাল—সবুজের পতাকা পেয়েছিলাম আমরা। সাড়ে সাত কোটি জনতা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেদের হাতে গড়ার আত্মবিশ্বাস পেয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রামে পাকিস্তানের দাপুটে সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করতে গিয়ে গ্রাম—শহর বিধ্বস্ত হয়েছিল, জনপদ হয়েছিল বিপন্ন, মানুষ হয়েছিল নিঃস্ব, পাক হানাদারের বর্বরতার চিহ্ন পড়ে ছিল যত্রতত্র।

স্বাধীনতা ও বিজয় দুটি এক কথা নয়। স্বাধীনতা একবারই আসে। কিন্তু বিজয় আসে বারবার। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান দেশের একটি ঐতিহাসিক বিজয়। বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যে ভরা সমাজ এখন বাংলাদেশ। দেশে—বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ছে এ দেশেরই বিশ্বাসঘাতক সমাজের একাংশ। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের বড় বিপর্যয় এভাবেই ঘটেছে। এর মধ্যে বিস্ময়ের ব্যাপার এটাই যে আজকের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান একটি মূল্যবোধ নিজ উদ্যোগে ধারণ করেছেন। সেটা হলো বৈষম্যবিরোধিতা। তারই ফল এ বছরের জুলাই—আগস্ট গণ—অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের বৈষম্যবিরোধী, জাতি ও ধর্ম—ঊর্ধ্ব চরিত্র এবং রাষ্ট্রসংস্কারের কথা স্পষ্ট করে বলেছে। রাষ্ট্রকে বৈষম্যমুক্ত করতে চাওয়ার দুঃসাহসী আওয়াজের মাধ্যমে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ১৯৭১ সালের মূল্যবোধকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ঠিক একই কারণে এই গণ—অভ্যুত্থানকে পথচ্যুত করার অপচেষ্টাও আছে।

‘‘নতুন বাংলাদেশ’’—এর স্বপ্নসারথি শিক্ষার্থী—জনতার প্রত্যাশা পূরণে রাষ্ট্রকাঠামোর আমূল সংস্কারের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক, বৈষম্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণ হোক এটি দেশের আপামর জনতা প্রত্যাশা রাখে। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাসহ একটি সুশাসিত বাংলাদেশ বিনির্মাণের চাহিদা চিরজাগ্রত রাখতে তারুণ্যই নেতৃত্ব দেবে। সেই পথ পরিক্রমায় অন্তবর্তীকালীন সরকারকে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপযুক্ত রাষ্ট্র সংস্কার ও জাতীয় রাজনৈতিক বন্দোবস্ত অর্জনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, চার জাতীয় নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সম্ভ্রমহারা দুই লক্ষ মা—বোন, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক—সমর্থক, বিদেশি বন্ধু, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যসহ সর্বস্তরের জনগণকে, যারা আমাদের বিজয় অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছেন। আরও স্মরণ করি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের। জাতিও তাদের অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

‘তরুণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নজিরবিহীন প্রাণহানি ও ত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের সাক্ষী হয়েছি আমরা। এই অভ্যুত্থানই প্রমাণ করে অদম্য, অপ্রতিরোধ্য তারুণ্যকে উপেক্ষা বা নিপীড়নের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। সকল রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে এই আন্দোলন থেকে সেই শিক্ষা নিতে হবে। ’নব্বইয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে প্রতিটি স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

এই যে জাতীয়তাবাদ, সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর।

আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক শোষণহীন সমাজে। সর্বশেষ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা আসলে বলতে হয়, ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা নয়। স্বাধীন বাংলায় সকল ধর্মের মানুষ তাদের ধর্ম পালন করবে স্বাধীনভাবে। কারণ স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজকের এই ’২৪ এর আন্দোলনে সকল ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো, সেই অবদান অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। ধর্মকে কেউ যেনো রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে না পারে তরুণ প্রজন্মকে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

বৈষম্য বিরোধী—ছাত্র আন্দোলনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মিল আছে। কেননা এই অনুভূতিও ছিলো — শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আন্দোলন, হার না মানার আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনের যে কী শক্তি সেটা ’৫২, ’৬৬, ’৬৯ এ প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ’২৪ এর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের উপর ভর করলো কিছু দেশদ্রোহী রাজনৈতিক অপশক্তি, স্বার্থান্বেষী মহল তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করলো। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করলো। যারা এই রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে তাদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি জাতি প্রত্যাশা করে, তেমনি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমেও ছাত্র হত্যার বিচার করা উচিত। নতুবা আবারও ছাত্র—জনতা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে তরুণদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই দেশে সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা ও সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হবে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দেশ বাংলাদেশ। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের গৌরব। বাংলাদেশ একটি বহুজাতিক, বহু—ধর্মীয় এবং বহু সংস্কৃতির দেশ। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সামাজিক বিভাজন ও বিদ্বেষমূলক ঘটনা আমাদের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংসের মুখে ধাবিত করছে। আমাদের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মকে সম্প্রীতির মূল্যবোধে উজ্জীবিত করা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বৈষম্য আর বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি না দিতে পারলে বিজয়ের আনন্দ ফিকে হয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের কাছে।

দেশের প্রধান সমস্যা বেকারত্ব, এই বেকারত্ব দূর করে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করতে হবে। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষার দক্ষতা অর্জনেরও সুযোগ করে দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সমতা বজায় রেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উন্নতমানের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। বর্তমান সময়ে এসে ধর্ম, বর্ণ ভুলে বৈষম্যহীন একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণের মাধ্যমে উন্নত—সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় রূপান্তর হোক এটিই সকলে প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাবেক কমান্ডার—বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাবেক যুগ্ম পরিচালক — বাংলাদেশ ব্যাংক, সদস্য সচিব— মুক্তিযুদ্ধকালীন ন্যাপ—কমিউনিস্ট পার্টি—ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রাম, সভাপতি—চট্টগ্রাম প্রাতিষ্ঠানিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লিঃ। সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর