বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ
একাত্তরের ৯ ডিসেম্বর পটিয়ার গৈড়লার টেকের মূলতঃ চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি আলোচিত সম্মুখযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে দক্ষিণ চট্টগ্রামে এত বড় যুদ্ধ আর হয়নি। আলোচিত ও সাহসিকতাপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয় ন্যাপ কমিউনিটি পাটি ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর দোসর রাজাকার, আল শামস, ও পুলিশ বাহিনীর। ওই যুদ্ধে শতাধিক পুলিশ ও রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। রাজাকার, মিলিশিয়া, বিহারি লরি ড্রাইভার ও হেলপার এবং পুলিশের লোক মিলে। দখলদার বাহিনীর দোসরদের মোট ১৪ জন এই সম্মুখযুদ্ধে নিহত হয়। এই যুদ্ধে গেরিলা বাহিনী সম্পূর্ণ অক্ষত থাকে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ গেরিলা বাহিনীর হাতে আসে। যুদ্ধে গেরিলা বাহিনী নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। আলোচিত ও সাহসিকতাপূর্ণ এই সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন সেদিনের বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ।
১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পটিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। এই অভিযানে ২২ জন সদস্য ছিল। ভারতীয় ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং বিপুল সংখ্যক ছিল স্থানীয় ট্রেনিং প্রাপ্ত। দলের কমান্ডার ছিলেন মোহাম্মদ শাহ আলম। যিনি বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। গৈড়লার টেকের সম্মুখযুদ্ধের গেরিলা সদস্যরা হলেন মোহাম্মদ শাহ আলম-কমান্ডার, উদয় নাগ-ডেপুটি কমান্ডার, মোহাম্মদ ইউছুফ।” (পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য)। মরিয়মনগর, রাঙ্গুনিয়া, শামশুজ্জামান হীরা-পাবনা, ফজল আহমদ- (পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক হিসেবে অবসর) তেকোটা, তপন দস্তিদার- ধলঘাট, পটিয়া, শেখর দস্তিদার (পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ) ধলঘাট, পটিয়া, সুজিত কুমার বড়ুয়া তেকোটা-পটিয়া, আনোয়ার হোসেন সরফভাটা-রাঙ্গুনিয়া, নজরুল ইসলাম ঊনসত্তরপাড়া-রাউজান, প্রিয়তোষ বড়ুয়া ছনহরা-পটিয়া, পুলক দাশ রতনপুর-পটিয়া, কামারুজ্জামান মিরসরাই-চট্টগ্রাম, মোয়াজ্জেম হোসেন পাবনা, সুনীল চক্রবর্তী শাকপুরা-বোয়ালখালী, ভূপাল দাশগুপ্ত আনোয়ারা, মোহাম্মদ আালী ঢাকা, মিয়া জাফর আহমদ-পূর্ব বাকলিয়া, অসিত দাশ-রেল কর্মচারী, শেখ মানিক-বন্দর ও পীযুষ বড়ুয়া বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ ব্যক্তিগত জীবনে বাংলাদেশ ব্যাংক যুগ্ম পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডার ছিলেন। কীভাবে গৈড়লার যুদ্ধ হল-এ প্রসঙ্গে তিনি – বলেন, ধলঘাট ইউনিয়নের সে সময়কার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ঈশ্বরখাইন নিবাসী মাওলানা ইমাম শরীফ বিভিন্ন সময় আমাদের কাছে দখলদার বাহিনীর নানা সংবাদ গোপনে সরবরাহ করতেন। তিনি আমাদের জানালেন পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও সাতকানিয়া থানার সকল পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র ও গুলির বাক্সসহ পটিয়া থানার সমবেত হয়েছে। তারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের কথা ভাবছে। আমাদের কমান্ডার মোহাম্মদ শাহ আলমের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি ওদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং সাব্যস্ত, হয়, ৯ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে ৯টার ধলঘাট ডিআইবি ক্যাম্পের নিকটবর্তী কোনো স্থানে ওই পুলিশ বাহিনী এবং সাথে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মিলিটারি গেরিলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। গেরিলাযোদ্ধা ফজলের মুখে শুনুন যুদ্ধের কাহিনি, ‘ধলঘাট ক্যাম্পের প্রবেশ পথে আমরা অ্যামবুশ করে আছি সকল সাতটা থেকে। নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও আত্মসমর্পণকারীরা নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হল না। একটু পরে পটিয়ায় ফাইনাল রেকি করতে যাওয়া দুজন ফিরে এল। তাদের কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল, পুলিশ বাহিনীর সকল সদস্য, ধলঘাটে এসে আত্মসমর্পণ একমত নয়। তাদের বড় একটি অংশ শহরে ফিরে যাওয়ার পক্ষে। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের পরিকল্পনা পাল্টাতে হল। সিদ্ধান্ত হলো গৈড়লার টেকে তাদের যানবাহনে অ্যামবুশ করব। আমরা দ্রুত গৈড়লার টেকে চলে গেলাম। জায়গাটা কমান্ডার, ডেপুটি কমান্ডারদ্বয় ও হীরা ভাই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে কিলিং জোন নির্ধারণ করলেন। পাকা সড়ক থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে ‘লম্বা লাইনে ধানখেত ও জমিনের আলকে আড়াল করে অবস্থান নিলাম ফ্রন্ট কাট অফ হিসেবে। তাদের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল পুলিশের গাড়ি ছাড়া অন্যান্য গাড়িগুলোকে আটকে দেওয়া। তিনজনের একটি দল রিয়ার কাট অফ হিসেবে শাহগদী মার্কেটের দিকে অবস্থান নিল। সেই দলের ওপর বাড়তি দায়িত্ব ছিল শহর থেকে আসা গাড়িগুলোকে আটকে দেয়া। মুল অপারেশনের আগেই প্রথমে বিয়ার কাট অফদের সাথে সশস্ত্র অবস্থায় ধরা পড়ল তিন মিলিশিয়া ও চার রাজাকার।
এদিকে পুলিশের বাস আসার আগেই কিলিং জোনে এসে ঢুকলো আজিজনগর থেকে চট্টগ্রাম শহর অভিমুখী রমনা : সিগারেট বোঝাই একটা ট্রাক। ওই ট্রাকের ড্রাইভার ও হেলপার ছিল বিহারি। ফ্রন্ট কাট অফদের সিগন্যাল অগ্রাহ্য করে ট্রাকটি দ্রুত পালাচ্ছিল। পুরো কিলিং জোন নির্বিঘ্নে অতিক্রম করে গেল ট্রাকটি। চাকা লক্ষ করে গুলি করেও দ্রুত ধাবমান ট্রাকটিকে থামানো যায়নি। কিন্তু কিলিং জোন পার হওয়ার মুখে পালবাড়ি ঘাটায় (সদর দরজা) রিয়ার কাট অফরা ড্রাইভারকে লক্ষ করে গুলি করে খতম করল। ট্রাক ছিটকে পড়ল রাস্তার পাশে। পালানোর পথে হেলপারও গুলি খেয়ে মারা গেল। দুপুর বারোটার কিছু পরে পুলিশ বোঝাই বাস কিলিং জোনে ঢোকলো। কমান্ডার কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম আকাশের দিকে গুলি ছুড়লেন তার স্টেনগান থেকে। অন্য মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আকাশের দিকে দুয়েক রাউন্ড গুলি করল। হীরা ভাইও তেমনিভাবে এলএমজি থেকে কয়েক দফা ব্রাশ ফায়ার করলেন। এ অবস্থায় পুলিশ বাহিনী তাদের বাস থামিয়ে জানালা দিয়ে অস্ত্র ফেলে দিতে শুরু করল। কমান্ডার শাহ আলম তা দেখে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘সিস ফায়ার’ আত্মসমর্পণ করো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোড়া বন্ধ করতেই শুনতে পাই পাল্টা ফায়ারিং এর আওয়াজ। বাসগুলো থেকে কয়েকজন নেমে গিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে ঊংং গুলি ছুড়ছিল। কয়েকজনের পরনে ছিল রাজাকারের পোশাক আবার কারো পরনে লুঙ্গি ও শার্ট। কেউ কেউ গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়েও যাচ্ছিল। ওদের ছোড়াগুলি শোঁ শোঁ শব্দ করে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় ওই লোকগুলোকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর ছিল না। ফলে ওখানে ওদের পাঁচ জন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এরপর ওই বাসগুলোর দিকে আসা গুলির আওয়াজ বন্ধ হল। বুঝতে বাকি রইল না কেন ওরা পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ধলঘাটে আত্মসমর্পণ করেনি। পুলিশদের মধ্যে একটা অংশ এবং তাদের সাথে থাকা কিছু, রাজাকার ও মিলিশিয়া সদস্য এই আত্মসমর্পণের পক্ষে ছিল না। তারা শহরে ফিরে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল। পুলিশদের বিরাট অংশ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে এ তথ্য তাদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তারা সম্ভবত পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে এসে তথ্যও প্রেরণ করেছিল। এই অনুমানের কারণ হল, গৈড়লার টেকে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন পাকিস্তানি বাহিনীর একটা দল দুটো পিকআপে করে শহর থেকে পটিয়ার দিকে আসছিল। এর আগে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের একটা দল পটিয়ার দিকে আসতে গিয়ে আমাদের হাতে ধরা পড়ে খতম হল। পাকিস্তানি বাহিনীর যে দলটি শহর থেকে পটিয়ার দিকে আসছিল তারা মনসা বাদামতলে এসে এলএমজি ও স্টেনগানের ব্রাশফায়ারসহ ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ পেয়ে আবার শহরের দিকে ফিরে যায়। একইভাবে আমাদের অ্যামবুশে পড়া বাহিনীর পেছনে পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর পিকআপ ছিল যেগুলো কাগজীপাড়া মসজিদের ওখান থেকে ফিরে যায়। গেরিলা বাহিনীর হাতে পাক হানাদার বাহিনী যুদ্ধে পরাজয়ের সংবাদ আশ-পাশের গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার সমবেত হয়। তারা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদের সামরিক সরঞ্জমাদিসহ শত শত মানুষ বহন করে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মূলতঃ ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা শত্রু মুক্ত হয়। ন্যাপ-কমিউটিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনীর ঐতিহাসিক বিজয়ের ইতিহাস মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। উল্লেখ্য যে, সরকারী উদ্দ্যোগে গৈড়লার টেকে বিজয় স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক কমান্ডার-বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সাবেক যুগ্ম পরিচালক – বাংলাদেশ ব্যাংক, সদস্য সচিব- মুক্তিযুদ্ধকালীন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, চট্টগ্রাম, সভাপতি-চট্টগ্রাম প্রাতিষ্ঠানিক বীর মুক্তিযোদ্ধা সমবায় সমিতি লিঃ। সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সমাজ কল্যাণ পরিষদ, চট্টগ্রাম মহানগর।
Leave a Reply