আজ ৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সদর আমিন মসজিদ: বাঁশখালীর ঐতিহ্যের প্রতীক

Spread the love

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম একটি ঐতিহাসিক জেলা। প্রাচীনকাল থেকে এই চট্টগ্রামে মানববসতি শুরু হয়। এই চট্টগ্রামে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এখনো পাহাড়-সমতল-সমুদ্রের পাদদেশে এই চট্টগ্রামের ধর্মীয় শান্তিশৃঙ্খলার মাধ্যমে মানববসতির ইতিহাস নজিরবিহীন। চট্টগ্রাম জেলা শহর থেকে সোজা দক্ষিণে আনোয়ারার পরেই বাঁশখালী উপজেলা। বাঁশখালী উপজেলা সদরের একটু আগেই ৫নং কালীপুর ইউনিয়নের কালীপুর গ্রামে আজ হতে প্রায় দু’শত বছর আগে ঐ এলাকার কৃতী সন্তান খানবাহাদুর আনোয়ার আলী প্রকাশ সদর আমিন সাহেব তাঁর এলাকায় মসজিদ, হাট, রাস্তাঘাট, খালখননসহ এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি সদর আমিন হাটের দক্ষিণ পাশে কালীনপুর গ্রামে বর্তমান বাঁশখালী রোডের পূর্বপাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘সদর আমিন জামে মসজিদ’। মোগল স্থাপনায় সজ্জিত এই প্রাচীন মসজিদটি বাঁশখালীর ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি শুক্রবারে দূর-দূরান্ত থেকে সদর আমিন জামে মসজিদ নামাজ পড়তে মুসল্লিরা আসেন। প্রাচীন এই মসজিদের ইতিহাস ও লোকমুখে জনশ্রুতি মতে ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব দি মোহামেডান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম (১৮৫৬-১৯৩১)’র গ্রন্থ ‘আমার পীরে’ সদর আমিন জামে মসজিদের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। মসজিদের ইতিহাস নি¤œরূপ: আলহাজ্ব খানবাহাদুর আনোয়ার আলী খান জন্ম ১৮১২ ইংরেজি, তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম সাবজজ, ও সদর আমিন। তাঁর পিতা ছিলেন আলহাজ্ব শেখ মুহাম্মদ রওশন আলী। সদর আমিন সাহেবের শ্বশুর ছিলেন আলহাজ্ব মুন্সী জাফর আলী খান, তিনি ছিলেন ততকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমমোক্তার। যাঁর বাসভবন হল চট্টগ্রাম শহরে জাফর আলী হিল (বর্তমানে ডিসি হিল, ডিসি’র বাংলো)। আলহাজ্ব খানবাহাদুর আনোয়ার আলী খান তাঁর নিজ এলাকার সমাজ উন্নয়নের জন্য সদর আমিন হাট, সদর আমিন মসজিদ, সদর আমিন খাল খনন করেন তাঁর নিজ ফান্ড থেকে, যাতে করে খালে থেকে সেচপ্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি ও সমাজে আর্থিক উন্নয়ন। মসজিদে যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন তাদের জন্য জনপ্রতি ৫ কানি করে কৃষি জমি দেওয়া হয়েছে সেই সময়ে। এই মসজিদে ইমামতি করেছেন পবিত্র মির্জাখীল দরবার শরীফের ২য় শাহ জাহাঁগীর, মসনবী শরীফে তফসীরে রুহুল বয়ান ও বহু কিতাবে বর্ণিত পৃথিবীর পূর্ব দেশের গৌছ ও কুতুব গৌছে মাশায়েখ, সুলতানুল আরেফীন, বুরহানুল সালেহীন, কুতুবুল মোকাশশেফীন, ইমামুল ওয়াসেলিন হজরত ফখরুল আরেফীন (ক.), হজরত ডিপুটি শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম (রহ.), হজরত শাহ মোহাম্মদ মজহেরুল আলম (র.)। এই বুজুর্গ মসজিদ এটাতে রাতে বহু জীন পরি নামাজ আদায় করেন। তিনি জনসাধারণের জন্য আমাদের বাড়ির পূর্বপাশে দরগা মুড়ায় সারে ছয় কানি পাহাড় দিয়ে গেছেন। যাতে করে সাধারণ মানুষের কবর দিতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ এখনো পর্যন্ত মানুষের কবরের জাগা দিয়ে আসছেন। আলহাজ্ব খানবাহাদুর আনোয়ার আলী খান-এর একমাত্র পুত্রসন্তান হলেন ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত দার্শনিক ভারত গৌরব,ও সাংবাদিকতার পথিকৃৎ, মুসলমান কর্তৃক প্রথম ইংরেজি পত্রিকা ‘দি মোহামেডান অবজারভার’ (১৮৯২-১৮৯৪) কলকাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক এবং বহু গ্রন্থ প্রণেতা হজরত ডিপুটি শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম (রহ.)। যার সুনাম ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়ি পরেছিল। হজরত ডিপুটি শাহ মুহাম্মদ বদিউল আলম (রহ.) শাহ সাহেবের বিখ্যাত বই ‘what is manবর্তমানে আমেরিকার বিখ্যাত প্রকাশনি কেসিঞ্জার পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হচ্ছে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ আমেরিকার বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হচ্ছে। যা বিশ্বের বড় বড় লাইব্রেরীগুলোতে সংরক্ষিত আছে। হজরত ডিপুটি শাহ মুহাম্মদ বদিউল আলম (রহ.) তাঁর রচিত বিখ্যাত ‘আমার পীর’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন তাঁর পিতা সম্পর্কে ‘সেই মহাপুরুষ, আলেম, ফাজেল, হাজী, দরবেশ, ছদর আলা (সাবজজ), খাঁ বাহাদুর, অকৃত্রিম দাতা, দয়ার সাগর, গরীবের মা বাপ, ক্রমে ক্রমে নিস্তেজ হইতে লাগিলেন; অবশেষে পূর্ণ ৮০ বছর বয়সে ১৮৯২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি তারিখে, প্রাতেঃ ৮টার সময় প্রকাশ্য জগৎ ত্যাগ করিয়া, আপন মৌলার সহিত মিলিত হইলেন। সেই দিনই তাঁহার নামাজের জানাজা ও দাফন শেষ হইল।’

১৮৯২ সনে ২৭শে ফেব্রুয়ারিতে ইন্তেকাল করেন এবং মূল মসজিদের দক্ষিণের জানালার পাশে আলহাজ্ব খান বাহাদুর আনোয়ার আলী খান, সদর আমিন সাহেব কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক আমিন। হজরত শাহ মুহাম্মদ মজহেরুল আলম (রহ.)-এর ছেলে মরহুম লোমানুল হক কাষ্টম সুপারিন্টেনডেন্ট-এর হাতে সংরক্ষণ ও মেরামত হত। এবং হজরত শাহ মুহাম্মদ মজহেরুল আলম (রহ.)-এর মেয়ে মেহেরুন নিসা (ফরুর মা) নিজ উদ্দেগে মসজিদের বারান্দার কাজ সম্পন্ন করেন। এই ২০০ বছরের পুরানো মসজিদটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগে হাতে সংরক্ষণে দাবি জানাই। এইটি মোঘল কারুকার্যে সৌন্দর্য ম-িত স্থাপনা এইটি আমাদের সম্পদ।

তথ্যসূত্র: (১) আমার পীর, লিখক, হজরত ডিপুটি বদিউল আলম (রহ.) (প্রথম প্রকাশ ১৯১৪); (২) বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য, লিখক, প্রফেসর আব্দুল করিম, স্যার। (প্রকাশ ১৯৯৭); (৩) চট্টগ্রামের ইতিহাস, লিখক, চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি (প্রথম প্রকাশ-৪ঠা আষাঢ-১২৮২ মগী)।

লেখক: মোহাম্মদ নাজমুল হক শামীম, সম্পাদক, লিটল ম্যাগাজিন চট্টলানামা; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস চর্চা পরিষদ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর