আজ ৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইসলামের যেসব সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে

Spread the love

যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহতাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত ও সম্মানিত।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। কল্যাণকামিতা স্বভাবজাত ধর্ম। যেখানে মানুষ ভালোর দিকে আহ্বান করে অন্যায় কাজ থেকে বাধা প্রদান করে ইনসাফের পথ দেখায় আর অত্যাচারের পর মাড়িয়ে দেয়। দানের প্রতি উৎসাহিত করে কৃপণতা থেকে বারণ করে। সুন্দর আখলাকের প্রতি আহ্বান করে খারাপ চরিত্র থেকে বাধা প্রদান করে। সত্য বলতে উৎসাহিত করে মিথ্যাকে ঘৃণা করে। আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখতে বলে। মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার কথা বলে। এ ছাড়া আরো আছে নানা সুন্দর কথা। নবীজি (সা.)-এর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.)-এর বলিষ্ঠ এক বক্তব্যে ইসলামের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। বাদশাহ নাজাশির রাজপ্রাসাদে মুসলমানদের মনোনীত মুখপাত্র হিসেবে জাফর বিন আবু তালেব অকপটে বলেছেন হে সম্রাট আমরা ছিলাম অজ্ঞতা অশীলতা ও অনাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত নিকৃষ্ট এক জাতি। আমরা প্রতিমা পূজা করতাম মৃত জীব-জন্তুর মাংস ভক্ষণ করতাম অশীলতায় লিপ্ত থাকতাম আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করতাম আমানতের খিয়ানত ও মানুষের হক নষ্ট করতাম এবং দুর্বল ও অসহায়দের সম্পদ কেড়ে নিতাম। এমন এক অন্ধকার জীবনে মানবেতর জীবনযাপন করছিলাম। তখন আলাহ তাআলা অনুগ্রহ করে আমাদের মধ্যেই একজন রাসুল প্রেরণ করলেন ; তার বংশ, মর্যাদা, সততা, সহনশীলতা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও পরোপকারিতাসহ আরো অনেক গুণাবলি এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত ছিলাম।

তিনি আমাদের আহ্বান জানিয়েছেন যে সমগ্র বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ ছাড়া আমরা আর কারো উপাসনা করব না। বংশ পরম্পরা সূত্রে এ যাবৎ আমরা যেসব প্রস্তর মূর্তি বা প্রতিমা পূজা করে এসেছি সেসব বর্জন করব। মিথ্যা বর্জন করব। পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব। অশীল ও অবৈধ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকব এবং রক্তপাত পরিহার করে চলব। এ ছাড়া নারীদের ওপর নির্যাতন ও তাদের প্রতি অহেতুক অপবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি আমাদের পরামর্শ দেন।

নিম্নে আমরা ইসলামের মৌলিক কিছু সৌন্দর্য তুলে ধরা হলো–

১. মানুষের স্বাধীনতা : ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে। মানুষকে মানুষের গোলামির শেকল থেকে মুক্ত হয়ে শুধু আলাহর ইবাদতের কথা বলেছে। মাথা অবনত একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সামনেই করবে। ইরশাদ হয়েছে-আমি জিন ও মানুষকে শুধু এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদত করবে। (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)

২. সবার সমান অধিকার : ইসলাম সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে। সুতরাং আরব-আজম, সাদাকালো, ধনী-গরিবের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নেই। একমাত্র সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি তাকওয়া বা আলাহভীতি। আবু হুরায়রা (রা.)-বলেন রাসুল (সা.)-বলেছেন মহান আল্লাহ তোমাদের জাহেলি যুগের মিথ্যা অহংকার ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথাকে বিলুপ্ত করেছেন। মুমিন হলো আলাহভীরু আর পাপী হলো দুর্ভাগা। তোমরা সবাই আদমসন্তান আর আদম (আ.)-মাটির তৈরি। মানুষের উচিত বিশেষ গোত্রভুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে অহংকার না করা। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১১৬)

৩. মা-বাবার বিশেষ মর্যাদা : যে মা-বাবা পৃথিবীর আলো দেখার মাধ্যম সেই মা-বাবাকে সম্মান ও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছে ইসলাম। । ইসলাম তার অনুসারীদেরকে পিতা-মাতার আনুগত্য করার নির্দেশ করে।

৪. প্রতিবেশীর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার : প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করতে নিষেধ করেছে। মানুষ যেই প্রতিবেশীর সঙ্গে সব সময় বসবাস করে অনেক সময় তার আচরণ ও উচ্চারণে কষ্ট পেয়ে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইসলাম আদেশ দিয়েছে ধৈর্য ধারণ করার জন্য এবং প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেওয়ার জন্য। নবী (সা.)-বলেছেন আলাহর শপথ! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আলাহর শপথ! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। আলাহর শপথ! সে ব্যক্তি মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আলাহর রাসুল কে সে লোক ? তিনি বলেন যার প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১৬)

৫. পশু-প্রাণীর প্রতি দয়া : ইসলাম ধর্মে অবলা প্রাণী-পশু-পাখির সঙ্গে সুন্দর আচরণ ও দয়া প্রদর্শন করার কথা বলা হয়েছে। ইসলাম প্রাণীদের অধিকার রক্ষার কথা বলেছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে কুকুরকে পানি পান করার কারণে আল্লাহ এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছে। সাহাবারা জানতে চেয়েছিলেন জীবজন্তুর (প্রতি দয়া প্রদর্শনের) জন্যও কি আমাদের পুরস্কার আছে ? রাসুল বলেছিলেন হ্যাঁ! প্রত্যেক দয়ালু অন্তরের অধিকারীদের জন্য প্রতিদান আছে।

৬. সামাজিক ভ্রাতৃত্ব তৈরি : যেসব জিনিস একে অপরের মাঝে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে সেসব বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে ইসলাম। অন্যকে দান করা হাসিমুখে কথা বলা আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখা ইত্যাদি। আর যেসব জিনিস ঘৃণা তৈরি করে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে-এসব থেকে নিষেধ করেছে। পরনিন্দা, অন্যের প্রতি খারাপ ধারণা, কাউকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রপ করা এগুলো জঘন্যতম অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়েছে। আলাহ তাআলা সুরা হুজুরাতে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ কোরো না এবং একে অন্যকে মন্দ উপাধিতে ডেকো না। অনেক রকম অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। তোমরা কারো গোপন ত্রুটির অনুসন্ধানে পড়বে না এবং তোমাদের একে অন্যের গিবত করবে না।

৭. নিজেকে পরিপাটি রাখা : সাজসজ্জা সৌন্দর্য এগুলোর প্রতি উৎসাহ করেছে ইসলাম। সুন্দর পোশাক পরিধান করা, পরিপাটি চলা-এগুলো ইসলামের সৌন্দর্য। নিজেকে অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন ময়লা কর্দমাক্ত রাখার অনুমতি নেই ইসলামে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, মানুষ চায় যে তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতা সুন্দর হোক এও কি অহংকার ? রাসুল (সা.)-বলেন আল্লাহ সুন্দর তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। প্রকৃতপক্ষে অহংকার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায় অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৬)

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানব চরিত্রের উৎকর্ষ সাধনই এর মূল লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যে আল্লাহরাব্বুল আলামিন আদিযুগ থেকে নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে পাঠিয়েছেন মানবতার উৎকর্র্ষর পূর্ণতা প্রদানের জন্য। মহানবী (সা.)-বলেন আমাকে পাঠানো হয়েছে সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআলা বলেন ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজিম-অর্থাৎ হে মুহাম্মদ (সা.)-নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।
ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম। ইসলাম পৃথিবীর সব মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার কথা বলে। ইসলাম আমাদেরকে সবসময় সুন্দর কথা বলার নির্দেশ করে। আল্লাহ বলেন আর তোমরা মানুষকে সুন্দর কথা বলো। ইসলাম সবার মেধা-বুদ্ধি ও সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বহন করে। ইসলাম অন্যের বিপদে সঙ্কটে দুঃসময়ে এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের ধর্ম ইসলাম সৃষ্টির প্রতি দয়ার কথা বলে। অন্যের কল্যাণে এগিয়ে আসার কথা বলে। ইসলাম বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যথাসময়ে আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বন্ধন গভীর করতে হবে। এই ইবাদত বান্দার জন্যে রিজিকের দুয়ার খুলে দেবে। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবে। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে পিতা-মাতার আনুগত্য করার নির্দেশ করে।
সুতরাং কেউ যদি সুন্দর পোশাক পরিধান করে আর সুন্দর জুতা পরিধান করে এটা শরিয়তসম্মত-তা অহংকারের অন্তর্ভুক্ত হবে না। এ তো ছিল অল্প কিছু সৌন্দর্যের বর্ণনা। এ ধরনের হাজারো সুন্দর জিনিস নিয়েই ইসলাম ধর্ম। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার তাওফিক দান করুক। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি-তিনি আমাদেরকে হেদায়েতের সরল পথে পরিচালিত করুন। আমাদেরকে খাঁটি মুমিন হওয়ার তওফিক দিন। আলোচনার শেষপ্রান্তে এসে আরেকবার মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি। প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার পরিবার-সহচরবৃন্দের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

লেখক : ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি গবেষক কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর