আজ ২৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জাফর ইকবালকে আমৃত্যু ভুলতে পারব না আমি : ববিতা

Spread the love

অনলাইন ডেস্ক

‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী, হয়ে কারো ঘরণী, প্রাসাদেরও বন্দিনী, জেনে রেখো প্রেম কভু মরেনি…’ ভাঙা হৃদয়ে বড্ড অভিমান নিয়ে গানটি কণ্ঠে তুলেছিলেন জনপ্রিয় নায়ক জাফর ইকবাল। কিন্তু কেন তাঁর এ বিরহ ব্যথা? ১৯৭৫ সালে ইবনে মিজান পরিচালিত ‘এক মুঠো ভাত’ ছবির শুটিং চলছিল। এ ছবিতে জুটি বাঁধলেন জাফর ইকবাল ও ববিতা। তখনই পাঠকপ্রিয় সিনে পত্রিকা চিত্রালীতে দুজনের ঢাউস রোমান্টিক ছবি ছেপে প্রকাশ করা হলো তাঁদের প্রেম কাহিনির গুঞ্জন। ধীরে ধীরে অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, দুজনের সম্পর্ক আর গুঞ্জনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। জল গড়ায় বহুদূর। কিন্তু বিধিবাম! এ প্রেম আর পরিণতি পায়নি। কিন্তু কেন এ মধুর সম্পর্ক বিষাদে গড়ায়। যদিও তাঁদের দুজনের কেউ-ই এ নিয়ে কখনো মুখ খোলেননি। একসময় আলাদাভাবে সংসারীও হন দুজন। তাঁরা প্রায় ৩০টি সিনেমায় জুটি হয়েছিলেন। যার সুবাদে দুজনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল চমৎকার একটি সম্পর্ক। জাফর ইকবাল আজ আর বেঁচে নেই। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতেই ববিতা স্মৃতিকাতর হয়ে অকপটে স্বীকার করেন, ‘জাফর ইকবালকে ভীষণ পছন্দ করতাম। খুবই স্মার্ট, গুড লুকিং ছিল সে। আমি তাঁকে ভালোবাসতাম, সেও আমাকে ভালোবাসত। শুটিংয়ের অবসরে অথবা নানা আড্ডায় আমাকে গান শেখাত। আমরা দুজন গিটার বাজিয়ে ইংরেজি গানের চর্চা করতাম।’ ববিতা আরও বলেন, ‘অনেক বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে কাজ করেছি। অনেকের অভিনয়ে আজও মুগ্ধ আমি। কিন্তু আমার পছন্দের নায়ক ছিল জাফর ইকবাল। তাঁর কিছু জিনিস আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করত। সে সুদর্শন ছিল। তাঁর অভিনয় সাবলীল। তাঁর কণ্ঠ, ব্যক্তিত্ব, ফ্যাশন সচেতনতা, রুচিবোধ চমৎকার। খুব ভালো ইংরেজি গান গাইতে পারত। গিটার বাজিয়ে ওর মুখে ইংলিশ গান শোনাটা আমাদের সময়কার যে কোনো মেয়ের জন্য স্বপ্নের একটি মুহূর্ত। ওর মতো পরিপূর্ণ কোনো নায়ক আমাদের চলচ্চিত্রে আসেনি।’ একসময় তাঁদের এ প্রেম ভেঙে গেলে ওই সময় গুঞ্জন ছড়িয়েছিল যে, ববিতার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যান জাফর ইকবাল। যা তাঁর পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে।

পরবর্তীতে মদপানসহ অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে কিডনি জটিলতায় আক্রান্ত হন এ নায়ক এবং ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি মারা যান তিনি। জাফর ইকবালের প্রসঙ্গ আসতেই অনেকটা আবেগী হয়ে ববিতা আরও বলেন, ‘ও খুব অভিমানী এবং আবেগপ্রবণ ছিল। কিছুটা বোহেমিয়ান স্বভাবের। জীবনযাপন ছিল কিছুটা অগোছালো। নিজের সময় তো বটেই, পরের সব প্রজন্মকেই প্রভাবিত করেছে ও। শুধু অভিনয় বা গান দিয়ে নয়, ব্যক্তিত্বের আবেদন, পোশাক, স্টাইল সব মিলিয়ে জাফর ইকবাল যেন ছিল এক গল্পের রাজকুমার। নিজস্বতা ছিল অভিনয়ে। সাবলীল, তবে চিত্তহরণে অনন্য।’ ববিতা বলেন, ‘আমরা প্রায় ৩০টি সিনেমায় জুটিবদ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে সে সময়ে অনেক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এমন গুঞ্জনের সময়ই মুক্তি পায় ‘অবুঝ হৃদয়’। বাংলা চলচ্চিত্র তাঁকে মনে রাখবে অনন্তকাল।’ এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কী আছে’ গানটি গেয়েছিলেন জাফর ইকবাল। কিন্তু কেন জাফর ইকবালের মতো একজন হৃদয়ে ঝড় তোলা প্রেমিক পুরুষ এমন বিরহের গান গেয়ে উঠলেন, এমন প্রশ্ন করতেই ববিতার জবাব, ‘আশির দশকে বিটিভির ২৫ বছর পূর্তিতে জাফর ইকবাল বিটিভিতে গানটি গেয়েছিল। এটি রাতারাতি ভীষণরকম জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল। গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটি সুর করেছিলেন প্রয়াত আলাউদ্দিন আলী। ব্যস, এ গান প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন শোনা গেল গানটি জাফর ইকবাল গেয়েছে আমাকে উদ্দেশ্য করে। আমাদের প্রেম নিয়ে সেই সময় শহরজুড়ে নানান গল্প বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুদর্শন নায়ক জাফর ইকবালের বিরহী কণ্ঠে সেই গান বৃষ্টি ঝরিয়েছিল বহু তৃষ্ণিত বক্ষে। কিন্তু আসলে জাফর আমাকে নিয়ে গানটি করেনি। আসল ঘটনা হলো- আলাউদ্দিন আলী তখন ভালোবাসতেন আরেক সংগীতশিল্পী সালমা সুলতানাকে। তখনো তাঁদের বিয়ে হয়নি। অভিভাবকরা সালমা সুলতানার বিয়ে ঠিক করে ফেললে আলী ভাই এ গানটি নিজ উদ্যোগে লিখিয়ে সুর দেন এবং জাফর ইকবালকে দিয়ে গাওয়ান। এ গান প্রচার হওয়ার পর সালমা সুলতানার বিয়ে স্থগিত হয় এবং তিনি পরে আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গেই জীবনের গ্রন্থি বাঁধেন।’ সব শেষে জাফর ইকবালকে তাঁর ভালোলাগার কথা স্বীকার করে ববিতা আবারও অতীত স্মৃতিতে ফিরে যান। বলেন, ‘আমাদের দুজনের জীবনে অনেক সুখ-দুঃখের গল্প আছে। যেমন একটি ঘটনার কথাই বলি। সত্তর দশকে একটি ছবির শুটিংয়ে আমি ও জাফর ইকবাল বান্দরবানে গেছি। আমাদেরসহ শুটিং ইউনিটের সবার থাকার ব্যবস্থা করা হলো পাহাড়ের ওপর একটি বাংলোয়। এত উঁচু পাহাড় থেকে কোনোভাবে পা পিছলে নিচে পড়ে গেলে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। এক দিন প্রায় দুপুর থেকে জাফর ইকবালকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভেবেছিলাম কোনো কিছুর জন্য হয়তো কোথাও গেছে সে। না, দুপুর গড়িয়ে বিকাল, তারপর সন্ধ্যা থেকে রাত। কোনো খবর নেই ওর, সবাই মিলে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাচ্ছিলাম না তাঁকে। সবার মাঝে উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল। আমি ধরে নিয়েছিলাম হয়তো পাহাড়ের কিনারায় গিয়েছিল ও, অসাবধানতাবশত পা পিছলে হাজার ফুট নিচে পড়ে গেছে। ওকে আর কোনো দিন ফিরে পাব না। আমি অঝোরে কাঁদছি। সবাই তাঁকে খুঁজছে আর আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ দেখি- ‘এই যে আমি এখানে পপি (আমার ডাকনাম) বলে বসার ঘরের পর্দার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল ও।’ জাফর নাকি আমাকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্যই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিল।’ ববিতার কাছে আবারও প্রশ্ন- শেষ পর্যন্ত দুজন দুই ভুবনের বাসিন্দা হলেন কেন? ববিতা অনেকটা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে বললেন, ‘একটা সময় আমার মনে হলো আমরা সহকর্মী হিসেবেই ভালো আছি। এ মধুর সম্পর্কটা আজীবন টিকিয়ে রাখতে হলে বিয়ের বন্ধনে না জড়ানোই ভালো। এখন দেখছি আমার ভাবনাটাই সঠিক ছিল। ওকে আমৃত্যু ভুলতে পারব না আমি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর