ড. কাজী খসরুল আলম কুদ্দুসী
মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ প্রযোজ্য এবং উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ধারাসমূহের মূল বক্তব্য প্রায় কাছাকছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর ৫৫(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, একজন শিক্ষক বা কর্মকর্তার রাজনৈতিক মত পোষণ করার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কোনো আইনানুগ সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকার স্বাধীনতার প্রতি কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই চাকরির শর্তাবলী নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু বেদনাদায়ক ব্যাপার হলো, অল্পকিছু শিক্ষক রাজনীতিকে তাদের পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক দলের পূর্ণকালীন কর্মী হতে পছন্দ করেন। তারা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এতটাই সক্রিয় হয়ে ওঠেন যে, ছাত্রদের জন্য সময় দিতে পারেন না। প্রকৃ তপক্ষে, এই বিধানটি করা করা হয়েছিল যাতে শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করতে পারেন। মানুষ মূলত একটি রাজনৈতিক প্রাণী এবং রাজনীতি হল সে মাধ্যম যার মাধ্যমে আজকের ছাত্ররা আগামীকাল জাতির সেবা করবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা এবং সুস্থ রাজনৈতিক বিতর্কের জন্য আদর্শ পরিবেশ থাকাও কাম্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর ১৩(৩) ধারায় বলা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ধৃত জরুরি পরিস্থিতিতে এবং উপাচার্যের অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হলে, উপাচার্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গৃহীত পদক্ষেপের অনুমোদনের জন্য রিপোর্ট করবেন। এই ধরনের বিধান জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য রোখা হয়েছিল। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এর ভুল ব্যাখ্যাটি বেশ উদ্বেগজনক এবং তা হলো উপাচার্য যেকোনো কিছু করতে পারেন এবং তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছোট ছোট স্বৈরাচার তৈরীর অন্যতম হাতিয়ার ছিল এটি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত সময়ে তা প্রবলভাবে দেখা গেছে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এখানে অনেক শিক্ষককে এমন স্বৈরাচারের পক্ষে রীতিমত যুদ্ধ করতেও দেখা গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর ১৩(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, উপাচার্য চার বছরের জন্য সিনেট কর্তৃক মনোনীত তিনব্যক্তির একটি প্যানেল থেকে আচার্য দ্বারা নিয়োগ করা হবে। এই ধরনের বিধান অন্যান্য প্রধান ৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদিও কয়েক দশক ধরে, আইনের এই মূল বিধানটি সরকারগুলি দ্বারা খুব কমই চর্চিত হয়েছে। সমীকরণটি এখানে বেশ সহজ সরকার যদি উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৯৭৩ সালের আইনকে কঠোরভাবে মেনে চলতে যায়, তাহলে সরকার যাকে ইচ্ছা তাকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে পারবে না এবং সিনেট দ্বারা নির্বাচিত উপাচার্যরা সর্বদা সরকারের কোন ভ্রান্ত নীতির সাথে একমত নাও হতে পারেন। তাই ১৯৯১ সালে বাংলদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার পর থেকে সব সরকার এক্ষেত্রে চরম শঠতার পরিচয় দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, নিকট অতীতে বেশিরভাগ উপাচার্য ছিলেন সরকারের হাতে একধরনের পুতুল এবং স্বায়ত্তশাসনের বহুল আলোচিত ইস্যুটি নিছক তামাশা। যদিও একজন সবল উপাচার্য চাইলে বাহ্যিক চাপ এবং অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষার মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন যে দৃষ্টান্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্থাপন করেছেন। একজন দক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চালিকাশক্তি এবং পরিবর্তন এর প্রধান নেতা হতে পারেন। নিকট অতীতে এই গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধ, নিশ্চল ও দুর্নীতিবাজদের নিয়োগ করার প্রবণতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে।
আদর্শগতভাবে, একটি গণতান্ত্রিক সরকারের উচিত, নিশ্চিত করা যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উপাচার্যরা (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে) চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন। তবে এটি এখন সম্ভব নয়। বিগত সময়ের একপাক্ষিক দলীয় প্রভাব এটিকে বাস্তবায়ন অযোগ্যে প্রমাণ করতে পারে। যাই হোক, বর্তমান সরকার এমন ব্যক্তিদের উপাচার্য হিসাবে নিয়োগের জন্য যেতে পারে যারা মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং ন্যায়সঙ্গত আচরণের মূল্যবোধের প্রতি অবিচল থেকে দক্ষতার সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। নৈতিকভাবে ভালো এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ব্যক্তি নির্বাচন করা অসম্ভব নয়।
অতীতে দেখা গেছে, সরকার তোষামোদকারী, সুবিধাবাদী এবং বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের বেছে নিয়েছিল এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি সরকারের জন্যও সমস্যা তৈরি করেছিল। বিগত সময়ে এমন অনেককে উপাচার্যের পদ দখল করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোটা বাজাতে দেখা গেছে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর অন্যতম উদাহরণ। যার বিরুদ্ধে লেখক নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং শিক্ষক সমিতিসহ অন্যরা অনেক লড়াই করেছি, যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ও সাংবাদিক সমাজ জানেন। প্রকৃতপক্ষে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একজন উপাচার্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসাবে প্রশাসনের আচরণ এবং শিক্ষার মান তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। যদিও কোন কোন উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দক্ষতার সাথে চালানোর জন্য সর্বোত্তম চেষ্টা চালান, আজকাল এটি কিছুটা কঠিন। বেশির ভাগ সময় চেয়ার বাঁচানোর চিন্তায় মগ্ন থাকতে হলে শিক্ষার মান উন্নয়নে তারা কীভাবে তাদের মানসম্পন্ন সময়কে কাজে লাগাবেন? বিভিন্ন মহলের অস্থিরতা, সরকারি ছাত্র সংগঠনের মাস্তানি এবং রাজনৈতিক নেতাদের চাপ আজকাল অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান নির্বাহীদের জন্য আসল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ এর ক্ষেত্রে যদিও উপাচার্যের ইচ্ছা সর্বদা সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা যায় না, তবে উপাচার্যরা অ্যাডহক, সাময়িক ইত্যাদি নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপরিসীম অপব্যবহার করে দুর্নীতির মহীরুহতে পরিণত হন। প্রায় সবাই জানেন যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এর অন্যতম নিকটতম উদাহরণ। শিক্ষকদের বলা হয় জাতির বিবেক।
নীতিগতভাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সকলপ্রকার অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তাদের আওয়াজ তুলবেন, এটাই জাতির প্রত্যাশা। তবে বিগত সময়ে আমরা অনেকেই সঠিক ও যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। তবে দেরিতে হলেও সঠিক বোধোদয় এবং দলান্ধতার নাগপাশ থেকে বের হয়ে আসা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সোনালী দিন ফিরিয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি। একই সময়ে, মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য তত্ত্ব এবং প্রয়োগের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঠিক পদক্ষেপও প্রয়োজন হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ছাত্রসংসদ চালু করা এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। উপাচার্য না থাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন কার্যত অচল। সরকার হয়ত দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দেয়া শুরু করবে। সংগতকারণে লেখকের ব্যক্তিগত কোন অভিলাষ বা উপযোগিতা নেই। এতে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে যারা গুরুত্ব পাননি তারা প্রাধান্য পেতে পারেন।
এতে আশ্চর্য বা বিচলিত হবার কিছু আছে বলেও মনে করি না। বিগত ছাত্র আন্দোলনের পরে এদেশের শিশুরাও এখন রাজনীতিমনস্ক এবং এতে দোষের কিছুই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরোপুরি দলনিরপেক্ষ শিক্ষক পাওয়াও কঠিন। তবে ভিন্নমতের বলেই তিনি খারাপ, এমন ধারণা পোষণ নিতান্তই নেতিবাচকতা। উপাচার্যরা, যে মতাদর্শেরই হোননা কেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সবাইকে সাথে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন এবং নিকট অতীতের উপাচার্যদের দুর্নীতির দুর্নাম এর কথা ভুলে যাবেন না এবং স্বৈরাচারী হয়ে উঠবেন না সেটাই একান্ত কাম্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাড়াতাড়ি সচল, সুস্থ ও শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে উঠুক সেটাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি।
ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী প্রফেসর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।