আজ ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: রক্তক্ষরণ থামেনি বাঙালির হৃদয়ে

Spread the love

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির কলঙ্কময় শোকের দিন। এই দিনে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলকে। এসময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। জাতির পিতার মৃত্যু সংবাদে বাঙালিরা সেদিন শোকে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দ্রুত পাল্টাতে থাকে দেশের প্রেক্ষাপট। খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি। ঘোষণা দেন। হঠাৎ করে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। কঠিন এ বাস্তবতার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের আপামর জনতা প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বাঙালির কোখিতজনা দেশেও হয় বড়যন্ত্রের চোজনীতি সামাধান বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যে কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালা বদল হতে থাকে। দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর পুনরায় উত্থান ঘটে। আবার পুনর্বাসিত হয় চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীরা। ১৯৭৫ সালের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি সন্দকার মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। অধ্যাদেশটিতে বলা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। ১৯৭৯ সালের সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন মেজর জিয়া। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন।

তবে, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করে বিচার সম্পন্ন করা হয়। বিশ্বদরবারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন বিশ্বনেতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তির অপচেষ্টা হয়েছে সে ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই বিশ্ববাসী তোমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার নামেই বাঙালিকে স্বাধীন জাতির মর্যাদা দিয়েছে। আমি শুধু বলব, পৃথিবীতে দু-শ্রেণির প্রাণী আছে। মনুষ্যপ্রাণী ও অমনুষ্যপ্রাণী। তোমাদের বাঙালি জাতির ভাগ্য পাল্টাবে কে, যদি তোমাদের মনুষ্যজাতির মধ্যে অমনুষ্যপ্রাণীর আধিপত্য প্রবল হয়ে ওঠে। যারা বিশ্বনন্দিত মহামানবসম শেখ মুজিবকে হত্যা করে অহংকার করতে পারে, তারা নরকের কীট। প্রিয় স্বদেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী চিন্তা-চেতনায় দীর্ঘদিনের শোষিত-বঞ্চিত এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে দেশকে যখন সামনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকেন তখনই বঙ্গবন্ধুর এই সফলতার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বনেতাদের চোখে ছিলেন এক ঐতিহাসিক ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক, এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করেছেন তার ব্যক্তিত্ববোধ ও নেতৃত্বের জন্য। বিগত বিংশ শতাব্দীর জীবন্ত কিংবদন্তি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণিত, বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকান্ডের মধ্যে একটি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। তবে এটি শুধুই হত্যাকান্ড ছিল না, বরং একটি সদ্য স্বাধীন ও জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রও ছিল।

হাজার বছরের নির্যাতিত-নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতিকে শেখ মুজিব ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতনের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছিলেন। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্বের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। এজন্যই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তিনি আজো আছেন বাঙালি জাতির পথপ্রদর্শক হয়ে। বঙ্গবন্ধুই বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা, ইতিহাসের মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের কুশীলবদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী সকল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জাতি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ দেখতে চাই।

ফজল আহমদ বীর মুক্তিযোদ্ধা: সাবেক কমান্ডার, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ: সহ-সভাপতি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর