আজ ১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৭শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

গরমে শিশু যেভাবে থাকবে রোগবালাইমুক্ত

Spread the love

ডা. মো. কামরুজ্জামান

চলছে গ্রীষ্মকাল। দেশজুড়ে বইছে দাবদাহ। গরমে অতিষ্ঠ সবাই। বিশেষ করে শিশুরা সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই সঠিক যত্ন না নিলে শিশুরা অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে বলে তারা সহজেই মৌসুমি নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এখন প্রচণ্ড গরমের সময়। এ সময় শিশুদের মধ্যে সচরাচর দেখা দেওয়া অসুখগুলোর মধ্যে ডায়রিয়া, বমি, পানিস্বল্পতা, জ্বর, সর্দি-কাশি-নিউমোনিয়া, পানিবাহিত রোগ, টাইফয়েড, জন্ডিস, রক্ত আমাশয় তাপজনিত মূর্ছা যাওয়া, হিটস্ট্রোক ইত্যাদি অন্যতম।

ডায়রিয়া, বমি, পানিস্বল্পতা

প্রচণ্ড গরমের এই সময় প্রয়োজনমতো তরল বা পানি পান না করলে শিশু ডিহাইড্রেসন বা পানিস্বল্পতায় পড়তে পারে। বমি, ডায়রিয়া বা দুটিতেই আক্রান্ত হলেও শিশুর পানিস্বল্পতা হতে পারে। মৃদু বা মাঝারি ধরনের পানিশূন্যতায় জিভ শুষ্ক হয়, কাঁদলে চোখ দিয়ে সামান্য পানি পড়ে, হার্ট রেইট বেড়ে যায়, ছয় থেকে আট ঘণ্টায় একবারও প্রস্রাব হয় না, অস্থিরতা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।

আবার মারাত্মক পানিস্বল্পতা হলে মুখগহ্বর খুব শুকনো হয়, পেটের চামড়া, বাহু, পায়ের চামড়া শুকনো ও ঢিলা হয়ে যায়, শরীর নিস্তেজ ও ঘুম ঘুম ভাব থাকে, চোখ গর্তে ঢুকে যায়, মাথার চাঁদি (ইনফ্যান্ট বয়সে) ভেতরে বসে যায়, দ্রুত ও গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, দ্রুত ও দুর্বল পালস হয় ইত্যাদি।

এমতাবস্থায় বাসা-বাড়িতে রেখেই পানিশূন্যতা সারিয়ে তোলা যায়। এজন্য বারবার অল্পস্বল্প তরল খাবার বা পানীয় খাইয়ে যেতে হবে। প্রতি ১৫ থেকে ২০ মিনিট অন্তর বয়স অনুযায়ী পরিমাণমতো এক-দুই চামচ করে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।

জ্বর

শিশু বয়সে সাধারণ একটি রোগ জ্বর। গরমের সময়ও শিশুদের জ্বরের হার বাড়ে। তবে শিশু যদি খেলাধুলা করে, ভালোভাবে খেতে পারে, পানীয় বা মায়ের দুধ পান করতে সক্ষম হয়, ত্বকের রং স্বাভাবিক থাকে, যদি হাসি-খুশি ভাব থাকে এবং জ্বর কেটে গেলে তাকে স্বাভাবিক দেখায় তবে বুঝতে হবে, এ জ্বর তেমন মারাত্মক নয়। আর যদি আসে তবে জ্বরের শুরুতেই প্যারাসিটামল খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। দুই মাস নিচের বয়সি শিশুদের জ্বরের সিরাপ না দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। দুই বছরের বেশি হলে জ্বরের সাসপেনশন (এসিটামিনোফোন) খাওয়ানো যেতে পারে।

জ্বর কমাতে গরম পানিতে নরম কাপড় ভিজিয়ে শিশুর পুরো শরীর স্পঞ্জ করে দিন। আইসপ্যাক, ঠাণ্ডা পানি বা অ্যালকোহল ব্যবহার করা উচিত নয়। এতে পরবর্তী সময়ে জ্বর বেড়ে যায়। পাতলা ও ঢিলাঢালা পোশাক পরান। খেয়াল রাখতে হবে, ঘরের তাপমাত্রা যেন অধিক উত্তপ্ত বা শীতল না হয়। বেশি বেশি তরল খাবার ও পানীয় খাওয়ান, যাতে সে পানিস্বল্পতায় না পড়ে। যেমনÑ স্যুপ। তবে চা, কফিযুক্ত পানীয় নয়। জ্বরের সঙ্গে বমি, পাতলা পায়খানা থাকলে মুখে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে। এই সময় আপেল জুস বা ফলের রস নয়।

সর্দি-কাশি-নিউমোনিয়া

ভাইরাস সংক্রমণ ছাড়াও গরমে শিশুর সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়া হওয়া বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। এজন্য বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। সর্দি হলে নাক বন্ধ হয়ে যায় বলে ‘নরসল’জাতীয় ড্রপস নাকে দিয়ে ঘুমানো ও খাওয়ানোর আগে ব্যবহার করা ভালো। অথবা হালকা গরম পানিতে এক চিমটি লবণ মিশিয়ে পরিষ্কার নরম কাপড়ে ভিজিয়ে নাকে দেওয়া যায়। মৌসুমি ফল, বিশেষ করে তরমুজ, ডাব, আনারস, পেয়ারা, কামরাঙা, কাঁঠাল, আম ইত্যাদি খেতে দিন। কাশি হলে কাশির সিরাপ খাওয়াবেন না। কারণ এর কোনো উপকারিতা নেই; বরং জটিলতা তৈরি হতে পারে। কাশি হলে ছোট শিশুদের লেবুর রস মেশানো গরম পানীয়, তুলসীপাতার রস ও একটু বড় শিশুদের লিকার চা দেওয়া ভালো।

জলবসন্ত বা চিকেন পক্স

গরমকালে শিশুদের জলবসন্ত হয়ে থাকে। এটা সাধারণত এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের বেশি হয়। তবে চিকেন পক্সের টিকা নেওয়া থাকলে এ রোগটি হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। এ সময় শিশুর বিশেষ যত্ন নিতে হবে। তাকে নরম সুতি কাপড় পরাতে হবে। তরল বা নরম জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। বেশি করে পানি খাওয়াতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে।

মূর্ছা যাওয়া

মূর্ছা যাওয়া মানে সাময়িক জ্ঞান হারানো। পানিস্বল্পতা, অত্যধিক গরম, রক্তে সুগার লেভেল কম, বেশি পরিশ্রান্ত হওয়াসহ অন্যান্য অসুখ ও মানসিক চাপে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এই গরমের সময়। তবে মূর্ছা গেলে তার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করা জরুরি, যাতে করে দ্বিতীয়বার না হওয়ার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এর মধ্যে শিশুটি কী মূর্ছা যাচ্ছে, না মূর্ছা গেছে প্রথমেই তা নিরূপণ করতে হবে। শিশু যদি মূর্ছা যাবে মনে হয়, তবে তাকে শুইয়ে দিন বা দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে বসিয়ে দিন। শিশুটি যদি মূর্ছা যায়, তবে পায়ের দিক একটু উঁচুতে রেখে, মাথার দিক খানিকটা নিচে রেখে শিশুটিকে শুইয়ে রাখুন। যদি মনে হয় শিশু পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে, তবে বেশি নড়াচড়া করাবেন না। আঁটসাঁট কাপড় সরিয়ে ঢিলেঢালা কাপড় পরিয়ে দিন। পরিষ্কার ভেজা কাপড় দিয়ে মুখ মুছে দিন। ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন।

হিটস্ট্রোক

অত্যধিক গরমে শিশু অসুস্থ হয়ে যায়। গরমজনিত ক্লান্তি শুরু হয় আস্তে আস্তে; কিন্তু সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে তা স্ট্রোকে পরিণত হয়। হিটস্ট্রোকে শিশুর তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ সময় ত্বরিত মেডিক্যাল ব্যবস্থাপনা না নিলে হঠাৎ মৃত্যুও ঘটতে পারে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে শিশুটির তীব্র মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, দ্রুত শ্বাস ও হৃদস্পন্দন, জ্ঞান হারানো, কোমা, খিঁচুনি, ত্বক শুকনো, গরম, তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হতে পারে। এ সময় করণীয় হলো গরমজনিত কারণে হিটস্ট্রোক হলে তাড়াতাড়ি শীতল স্থানে বা ছায়ায় নিয়ে আসুন। শরীর থেকে কাপড়-চোপড় খুলে দিন, পাখা দিয়ে বাতাস করুন বা ফ্যান ছেড়ে দিন। পায়ের দিক উঁচু করে রেখে শিশুকে শুইয়ে দিন। জ্ঞান ঠিক থাকলে ঠাণ্ডা পানিতে শরীর মুছে দিন। ঠাণ্ডা, পরিষ্কার, তরল বা পানীয় খেতে দিন।

স্কুলগামী শিশুর খাবার

এখন যেহেতু বেশ গরম তাই তাপমাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে বাচ্চাদের সুস্থতার বিষয়টা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সেজন্য শিশুদের টিফিন এবং তাদের সারাদিনের খাবারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত মনে রাখতে হবে শিশুর স্কুলের সময় তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খাবারগুলো ঠিক করতে হবে। খুব সহজে হজম হয়, শিশু অনেকক্ষণ এনার্জিটিক থাকে এ ধরনের খাবারগুলো সকালের জলখাবার হিসেবে দিতে হবে। বাচ্চাদের সকালের নাশতার মধ্যে প্রধান পুষ্টিগুণ বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলÑ এই জিনিসগুলো যেন থাকে যেমন : ডিম-রুটি-সবজি, দুধ-ওটস-কলা অথবা চিড়া-দই-কলা এবং এসব খাবারের সঙ্গে একটা ডিম। টিফিনে দ্রুত পচনশীল খাবার, গরমের কারণে গন্ধ হয়ে যেতে পারে এ ধরনের খাবার টিফিনে না দেয়াই ভালো। গরমের দিনে শিশুদের হালকা টিফিন যেমন ছোট ছোট দইয়ের কন্টেইনার অথবা মৌসুমি ফল যেমন: টুকরো করা পেয়ারা, মালটা (মোসাম্বি), ড্রাই ফ্রুটস যেমন: বাদাম, কিসমিস, খেজুর মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এগুলো ভালো টিফিন হতে পারে।

এছাড়া শিশুকে বাসা থেকে পানির পটে পানি দিয়ে দিতে হবে। সারাদিনে সে পানিটা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, ঠিকমতো ইউরিন পাস করছে কিনা সেই বিষয়গুলো বাবা-মাকে খেয়াল রাখতে হবে এবং এ ব্যাপারগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

ডা. মো. কামরুজ্জামান : সহযোগী অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ,

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর